ভাষান্তর : আল্লাদিত্তা মোহাম্মদ আলাউদ্দিন
হেমন্ত দিন
প্রভু, সময় হলো। গ্রীষ্ম ছিল অসাধারণ, এখন
বিছিয়ে দাও দীর্ঘ ছায়া তোমার সূর্য-ঘড়িটার
উপর এবং তৃণভূমির চারপাশে বয়ে দাও
হাওয়ার লুটোপুটি। আজ্ঞা করো, শেষ ফসলেরে
মাত্র দাও আর দু’টো দখিনা দিন, রঞ্জিত হতে
আরো মধুময় হতে ভারী দ্রাক্ষাপুঞ্জকে। আজও
যদি গৃহহারা তবে পাবে কি গৃহ আর, আজও
যদি একা থাকে একাই রইবে জীবন, লিপিকারের
পড়ে যেতে হবে ফেলে আসা নিভু নিভু আলোতে,
অন্তহীন চিঠি লিখবে সে অন্ধগলিতে উদ্ভ্রান্ত
বেদনায় অস্থির হেঁটে-হেঁটে, যেন ব্যাকুল বাতাসে
একলা বেলার একটি শেষ ঝরা পাতা।
তুমি, প্রতিবেশী খোদা
প্রতিবেশী খোদা
তুমি দুর্লভ অতি, প্রাণ
স্পন্দনে আর বড় বেশি
একা। তাই কখনও
কখনও সজাগ করি রাতে
শব্দ উল্বণে। কেউ নেই
যখন তৃষিত তুমি
অন্ধকারে। দাও ইশারা
ছোট, আমি বড় নিকটে।
সূক্ষ্ম দেয়াল এক মাঝে
আমাদের, তোমার-আমার
ঠোঁট নিঃসৃত নিঃশব্দে
যা ভাঙনের। সে দেয়াল
উৎকর তোমারই চিহ্নে, যে চিহ্ন
পরায় তোমাকে শিকল নামের।
যখন আলো বিচ্ছুরিত সুউচ্চতার
মাঝে, তোমাকেই জানি তোমাতে
হৃদয়ের গভীরে। বিচ্ছুরণ বৃথা
লুটায় নামের বন্ধনে, তুমিহীন সকল
পরশ আমার যায় মিথ্যায় মিলায়ে।
অন্ধ হওয়া
সবারই সঙ্গে সে বসে ছিল চায়ের টেবিলে।
এবং দেখলাম যেন তার পেয়ালা তোলা হলো
একটু ভিন্ন রকমে। সে হাসলো একটুখানি।
কী এক বেদনায় হৃদয় ভারী হলো তখনই।
অবশেষে যখন তারা মৃদু স্বরে কথা
বলতে বলতে চলে গেল ধীরে,
দেখলাম সে ছোঁয়া দিচ্ছে
হাসিতে কথাতে একে আর ওকে।
সবার মাঝে হেঁটে যায় সে আলতো
পায়ে, যেন গাইবে সে-
এখনই প্রাপ্তকূলের মাঝে; সাগর বুকে
কিরণ ছটার মতো খেলে যায় আনন্দ
ঝলক তার দুটি প্রদীপ্ত তীক্ষ্ম চোখে।
প্রলম্ব ঊর্ধ্বারোহণে সময় নিতে হাঁটছিল
সে ধীরে; এবং জানি উড়াল দেবেই সে
হারাতে দিগন্তে।
কী করবে তুমি, ঈশ্বরী, যখন মৃত আমি
যখন মৃত আমি, কী করবে ঈশ্বরী তুমি?
যখন থাকব পড়ে ভাঙা তোমার পাত্রখানি,
তোমার সুধা নষ্ট-শুষ্ক আমি, করবে কী তুমি?
আমাকে হারালে হারাবে তোমার অর্থ তুমি;
যারে নিয়ে ব্যস্ত, তারই আব্রু আমি।
আমাকে ছাড়া উষ্ণ-মধুর গৃহহীন
হবে তুমি। কোমল চন্দন আমি:
ক্লান্ত পায়ে খুঁজতে হবে কোথায়
হারিয়েছি আমি। পড়বে খসে তোমার
রাজসিক বস্ত্রাবলি, অসহায় খুঁজবে তুমি,
তোমার দৃষ্টি আমার কপোল
জুড়ি, দিয়েছিল তোমাকে শান্তি
বালিশ-উষ্ণতায় ভরি।
অজানা শীতল পাথুরে প্রান্তে ডুবে
যাওয়া সূর্য রঙে ঈশ্বরী,
আমি ভীত, কী করবে তুমি?
কবি পরিচিতি: ‘প্রতিদিনের জীবন যদি নগন্য মনে হয়, এর জন্য জীবনকে দায়ী করো না; দায়ী কর নিজেকে যে যথেষ্ট কবি হয়ে উঠতে পারোনি, এর অসামান্য রূপকে ফোটাতে; স্রষ্টার কোনো অনটন নেই। তিনি বলেন হও, অমনি তা হয়ে ওঠে’- এই হলেন রাইনার মারিয়া রিলকে। পুরো নাম রেনে কার্ল উইলহেম জোহান জোসেফ মারিয়া রিলকে(১৮৭৫ – ১৯২৬)।
প্রাগে জন্মগ্রহণকারী, আস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান এই কবি ও ঔপন্যাসিক সাধারণভাবে মরমী কবি হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। তার লেখার মাঝে অক্লান্তভাবে পাওয়া যায় অনির্বচনীয় অবিশ্বাস, নির্জনতা আর প্রগাঢ় উদ্বেগের আলাপন। নয় বছর বয়সে পিতামাতার বিচ্ছেদ এবং ১৮৮৬ থেকে ১৮৯১ সামরিক স্কুলে শিক্ষা; যার মর্মবেদনার কথা রাইনার মারিয়া রিলকে বাকি জীবনে নানা সময় বলে গেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আইনের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও, একজন পূর্ণকালীন লেখকের জীবন যাপনে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন সে সময় থেকেই। প্রাগে জন্মগ্রহণকারী রিলকে মিউনিক, সেন্টপির্টাসবার্গ, প্যারিস, ইটালি, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি স্থানে জীবনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়াদে কাটিয়েছেন। এবং সেই অর্থে তাকে সর্ব ইউরোপিয়ান কবি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
রাইনার মারিয়া রিলকে কাব্যের মাঝে কোনো দূরবর্তী অতিপ্রাকৃত দেবতার সন্ধান করেননি। খুঁজেছেন মনুষ্যপ্রকৃতির কাছাকাছি আনন্দময় কাউকে। বরং, মানুষের সবচেয়ে তীব্র সচেতন অংশের, শিল্প-মানসের সৃষ্ট, পরমই ছিল তার আরাধ্য। যা কিছু সত্যে স্পন্দিত, সে পরম তার সব কিছুতেই আবর্তিত এবং পূজিত। তবে সে পরম এখনও ঘটমান, সেই অর্থে অপ্রাপ্ত, অসম্পূর্ণ এবং ভবিষ্যত। যে রাজাধিরাজের সামনে প্রজারা এখনও সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে নেই। যে মদ এখনও হয়নি সুপক্ক। রাইনার মারিয়া রিলকে কাব্যের মাঝে এই অপ্রচলিত ঐশ্বরিকতার কথাই বলেছেন। যাকে কেবল মাত্র শৈল্পিক সত্তার অধিকারীরা, তাদের মাঝে ধীরে তুলে ধরার প্রয়াস পায়, যারা শৈল্পিক টানে জীবন ও বস্তুর নিজস্ব গভীর-গোপন জীবনের প্রতি অধিকতর স্পর্শকাতর হয়ে ঘনিষ্ঠ হয় এবং প্রতিটি প্রাণীই যা বীজের মত বহন করে সেই মৃত্যুকে বোঝার চেষ্টা করে।